আহমাদুল কবির::
মালয়েশিয়ায় সদ্য সমাপ্ত ব্যাক ফর গুড কর্মসূচি চলাকালে বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ মাত্রা সংযোজন করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় ১ লাখ ৯২ হাজার ২৬০ জন অবৈধ বিদেশি তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে ৫৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন।
দেশটিতে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকরা মালয়েশিয়ার আইন ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা, অতিরিক্ত জরিমানা এবং কারাদণ্ডের ভয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে পারেনি। এ ছাড়া অনেক অবৈধ প্রবাসী আটক আতঙ্কে দিন পার করছে দেশটিতে।
অবৈধ প্রবাসীদের প্রতিনিয়ত ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করছে। এসব প্রবাসীরা সরাসরি ইমিগ্রেশনে আত্মসমর্পণ করলেও জটিল ও কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই দিন যাচ্ছে তাদের। ইমিগ্রেশনে আবেদন দাখিল করার পর ১৪ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষায় থাকাদের খাওয়া এবং যাতায়াত সমস্যায় পড়তেও হয়। অধিকাংশদেরই বিপুল অংকের জরিমানা ও ফ্লাইট টিকিট ক্রয় করাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোগী হলে ভোগান্তি আরও বেশি। এমতাবস্থায় হতাশা বিরাজ করছে প্রবাসীদের মাঝে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়া সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মানবসম্পদ মন্ত্রী এবং ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরতে ইচ্ছুকদের সুবিধা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সফরকালে মালয়েশিয়া সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ অভিবাসীদের সহজে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সাধারণ ক্ষমা ব্যাক ফর গুড কর্মসূচি ঘোষণা করে যা ১ আগস্ট ২০১৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত চালু ছিল।
এ কর্মসূচির আওতায় কোনোরকম শারীরিক শাস্তি ছাড়া শুধু ৭শ রিংগিত জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরার সুযোগ নিয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ২৬০ জন অবৈধ বিদেশি। এর মধ্যে ৫৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন বলে হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে।
মিশনের এক কর্মকর্তা জানান, হাইকমিশনের ৫ সদস্যের টিম ব্যাক ফর গুড কর্মসূচি মনিটর করে। এ সুযোগ গ্রহণের জন্য সরাসরি হাইকমিশন থেকে কিভাবে ট্রাভেল পারমিট নেবে এবং কীভাবে সরাসরি ইমিগ্রেশন থেকে স্পেশাল পাস নেবে সে বিষয়ে প্রচার করে।
যে কোনো প্রয়োজনে হাইকমিশনের সঙ্গে সরাসরি বা ফোনে বা সোশ্যাল মিডিয়ার (ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের, হোয়াটসঅ্যাপ) মাধ্যমে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করে। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত স্পেশাল ফ্লাইটের সুবিধা সম্পর্কে প্রচার করে। বিভিন্ন পরিদর্শনে, মতবিনিময় সভায়, সাক্ষাৎ এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করে। হাইকমিশনের অফিসিয়াল ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার করে। মিশনের সকল সদস্য ব্যাক ফর গুড সুবিধা গ্রহণের প্রয়োজনীয় তথ্য, ডকুমেন্ট ও পরামর্শ অবারিতভাবে প্রদান করে।
ব্যাক ফর গুড কর্মসূচির শুরুতে অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যাপক সংখ্যক পাসপোর্টহীন বাংলাদেশের নাগরিকদের স্পেশাল ট্রাভেল পারমিট প্রদান করা। প্রতিদিন আমপাংস্থ পাসপোর্ট সার্ভিস কেন্দ্রে গড়ে আড়াইশ আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনকারীর কাছ থেকে সরাসরি ট্রাভেল পারমিটের (টিপি) আবেদন সকালে গ্রহণ, সাক্ষাৎকার, যাচাই এবং প্রস্তুত করে একই দিন বিকেলে সরবরাহ করা হয়েছে যা নজিরবিহীন।
ইস্যু করার পূর্বে আবেদনকারীর সঙ্গে পাসপোর্টের তথ্য মিলিয়ে দেখা, সাক্ষাৎকার নেওয়া, যাদের পাসপোর্টের কোনো তথ্য নেই তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বাংলাদেশস্থ পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যাচাই করে নাগরিকত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। এরপর ট্রাভেল পারমিটে (টিপি) ২৩ ধরনের কাজ তথা নির্ভুল তথ্য লিখন, ছবি সংযোজন, সিল দেওয়া, ফটোকপি সংরক্ষণ এবং স্ক্যান করে সফট কপি প্রস্তুত করে আবেদনকারীর নিকট একই দিন সরবরাহ করেছে।
ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিটের সফট কপি ই-মেইলের মাধ্যমে হযরত শাহজালাল (র) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে প্রেরণ করেছে যাতে ট্রাভেল পারমিট এবং ভ্রমণকারী বাহক সম্পর্কে ইমিগ্রেশন নিশ্চিত হতে পারে। অনুরূপভাবে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন এবং ফ্লাইট পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো মিশন থেকে যে কোনো সময় ট্রাভেল পারমিটের যথার্থতা বা মৌলিকত্ব যাচাই করে নিয়েছে।
ট্রাভেল ডকুমেন্ট (টিপি) এর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিট (টিপি) বাংলাদেশি নয় এমন নাগরিক কর্তৃক ব্যবহার রোধ করা। বিদ্যমান ট্রাভেল পারমিটের উপর পাসপোর্টের মতো কোনো নিরাপত্তা চিহ্ন নেই। এজন্য ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিটের কপি হাইকমিশন সফট কপি করে সংরক্ষণ করেছে ফলে যে কোনো সময় যাচাই করে আসল টিপি কিনা নিশ্চিত করেছে।
ইমিগ্রেশন বা ফ্লাইট সংস্থা থেকে প্রেরিত সন্দেহজনক ট্রাভেল পারমিট (টিপি) যাচাই করে দেখা গেছে ট্রাভেল পারমিটের ছবি, নাম, ঠিকানা, পরিবর্তন করে এবং পাসপোর্ট নম্বর মুছে দিয়ে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। তবে কমিউনিটি, বিমান সংস্থা ও ইমিগ্রেশনের সহযোগিতায় এ ধরনের অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়েছে বলে হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে।
ব্যাক ফর গুড কর্মসূচির শুরুতে হাইকমিশন ঢাকা- কুয়ালালামপুর, ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনাকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌক্তিক মূল্যে পর্যাপ্ত ফ্লাইট ও টিকিট নিশ্চিত করার বিষয়ে সভা করে। যেন ইচ্ছুক নাগরিকরা নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে যেতে পারে। কর্মসূচির শেষের দিকে অধিক চাহিদার কারণে ফ্লাইটের টিকিটের মূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি এবং ফ্লাইটে আসন না পাবার কারণে দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে।
এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে হাইকমিশন বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করে। বাংলাদেশ সরকার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১৬টি বিশেষ ফ্লাইট প্রদান করে এবং টিকিটপ্রতি ১২ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দেয়। অন্যান্য ফ্লাইট পরিচালনা সংস্থাগুলোকেও কমমূল্যে টিকিট এবং অতিরিক্ত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করে।
ব্যাক ফর গুড কর্মসূচির মেয়াদ যতই শেষের দিকে আসে ততই কুয়ালালামপুরের আশপাশের (পুত্রাজায়া, জালান দূতা, শাহ আলম, ক্লাং) ইমিগ্রেশনে ভিড় বাড়তে থাকে। ফলে অধিকসংখ্যক সেবা প্রত্যাশীদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। অপরদিকে কষ্টার্জিত অর্থে কেনা ফ্লাইট টিকিটের মেয়াদও ফুরিয়ে আসে। ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে হাইকমিশন ইমিগ্রেশনের সঙ্গে আলোচনা করে বিনামূল্যে যাতায়াতের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করে দূরবর্তী ইমিগ্রেশন অফিস থেকে স্পেশাল পাস সংগ্রহ করে দিয়েছে।
মিশনের অনুরোধে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন রোগীদের জন্য আলাদা কাউন্টার করে এবং যাদের বিমান ভ্রমণের তারিখ শেষের দিকে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্পেশাল পাস দিয়েছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের ব্যাপক আপত্তির কারণে পূর্বের সাধারণ ক্ষমার ন্যায় এবার ইমিগ্রেশন ও ব্যক্তির মাঝখানে অহেতুক কোনো এজেন্ট ছিল না। ফলে অতিরিক্ত খরচ হয়নি এবং সেবা প্রত্যাশীরা সরাসরি ইমিগ্রেশন থেকে সেবা নিতে পেরেছে।
হাইকমিশনা ও ইমিগ্রেশন মহাপরিচালকের সঙ্গে ব্যাক ফর গুড কর্মসূচি এবং বিশেষ গ্রেফতার অভিযানসহ অন্যান্য সার্বিক বিষয়ে বৈঠকের ফলশ্রুতিতে ইমিগ্রেশন স্পেশাল পাশের মেয়াদ ৭ (সাত) দিন থেকে বৃদ্ধি করে ১৪ (চৌদ্দ) দিন করে। ফলে অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন অফিসগুলোর এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবস্থানের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার মাঝেও সীমিত সামর্থ দিয়ে হাইকমিশন সমন্বিত ও নিরলস প্রচেষ্টায় দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক বিপদগ্রস্ত নাগরিকদের জন্য নির্বিঘ্নে সেবা নিশ্চিত করতে পেরেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
পাঠকের মতামত: